যে ক্রিকেটারের জীবন সিনেমার মতো i ওশান টমাসের বোলিং অনুশীলন ততক্ষণে শেষ। ঘাম মুছতে মুছতে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের আউটারে একটা চেয়ার টেনে বসলেন দীর্ঘদেহী এই জ্যামাইকান। চুপচাপ। টিম বয়দের কাছে কোনো চাওয়া নেই। নিজের পানির বোতলটাও নিজেই নিয়ে এলেন। চারপাশে বিপিএলে তাঁর দল খুলনা টাইগার্সের খেলোয়াড়েরা হাসিঠাট্টা করছেন। ওশান টমাসকে এর কিছুই স্পর্শ করছে না। যেন ধ্যানমগ্ন। গতকাল দলের সঙ্গে যোগ দেওয়া আরেক ক্যারিবীয় জেসন হোল্ডারের সঙ্গেও মনে হলো তেমন খাতির নেই। নিজের মতো নীরবে অনুশীলন ও বিশ্রাম সেরে উঠে পড়লেন টিম বাসে।
দলের অন্যরা অবশ্য চুপচাপ টমাসকে দেখেই অভ্যস্ত। ২৭ বছর বয়সী এই ফাস্ট বোলার নাকি এমনই। নীরবতাই তাঁর পছন্দ। মাঠে অবশ্য এই টমাসই অন্য রকম। ব্যাটসম্যানের দিকে তাঁর ছোড়া বলগুলো যেন এক একটি আগুনের গোলা। দুই রকম চরিত্রের এই জ্যামাইকানের জীবনটাও অদ্ভুত। তাঁর ২৭ বছরের জীবন নিয়ে সিনেমা বানালেও খারাপ চলবে না। একবার ভেবে দেখুন না! টমাসের বয়স যখন ১০, তখন তাঁর বড় ভাই খুন হয়েছেন মাদক মাফিয়ার গুলিতে। সেটাও নাকি ভুল করে! টমাসের ভাইকে অন্য গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী ভেবে গুলি করে মাফিয়ারা। প্রথমে পায়ে, এরপর বুকে ছয়বার।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সাদা বলের ক্রিকেটে ৪৬ ম্যাচ খেলা টমাসকে জীবনের কঠিনতম এই স্মৃতি নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। এরপর মাথা উঁচিয়ে হাত নেড়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘আমার বয়স তখন কত হবে, ৯-১০?’ তারপর আরেকটু ভাবলেন। হয়তো উত্তরের পরের অংশটা সাজালেন মনে মনে, ‘জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানতাম না। তবে বড় ভাই গোলাগুলিতে মারা যাবে, এটা তো কেউ কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। আপনাকে প্রতিদিন বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হয়, তা–ই না? আমিও তা–ই করছি।’ যে ক্রিকেটারের
বুঝতেই পারছেন, টমাস বেড়ে ওঠার প্রতিটি দিন ছিল সংগ্রামের। ক্রিকেট ছিল এসব থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথ। ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটারের আশপাশে বোলিং করে সেই পথটা বেশ দ্রুতই পাড়ি দিয়েছেন। জ্যামাইকা, সিপিএল থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ফেলেছেন ২৩-এর মধ্যেই। এসেছে স্বপ্নের আইপিএল চুক্তিও। কিন্তু সে পথে চলতে গিয়েও এসেছে বাধা। ২০২০ সালে মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন। দুটি গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। এতটাই যে প্রায় তিন বছর থাকতে হয়েছে খেলার বাইরে। গত বছরের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ড দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর দিয়ে ক্রিকেটে ফিরেছেন। ফ্র্যাঞ্চাইজি–দুনিয়ায় ফিরেছেন বিপিএল দিয়ে।
ফেরার এ আনন্দটা টমাস ভাগাভাগি করে নিলেন এভাবে, ‘আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পেরে ভালো লাগছে। ক্রিকেট খেলাটা আমি ভালোবাসি। আবার খেলায় ফিরতে আমাকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে। সুস্থ হয়ে নিজের দক্ষতা ও ফিটনেস নিয়ে অনেক কাজ করতে হয়েছে। হ্যাঁ, এত কিছুর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সিতে ফেরার অনুভূতিটা সত্যিই অসাধারণ।’
১৫০ কিলোমিটারের বোলার টমাস থাকতেও এবারের বিপিএলে সবচেয়ে দ্রুতগতির বলটা তাঁর দলের তরুণতম সদস্য নাহিদ রানার। গাড়ি দুর্ঘটনায় গতি কমে এল কি না, এ প্রশ্ন শুনে হয়তো একটু আহতই হলেন এই জ্যামাইকান। কথার সুরে ফুটেও বেরোল তা, ‘আমার তেমন মনে হয় না। ফাস্ট বোলিং জিনিসটা আমার জন্য একেবারেই সহজাত একটা বিষয়। গতি আমার সব সময়ই ছিল। ওই গাড়ি দুর্ঘটনা আমার গতি কমিয়ে দেয়নি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আমার প্রত্যাবর্তন সিরিজেই আমি ১৫০–এ (কিলোমিটার গতিতে) বল করেছি। এখানে আমি কন্ডিশনের চাহিদা অনুযায়ী বোলিং করছি। বেশি মনোযোগ দিচ্ছি আমার লাইন ও লেংথে। গতি এমনিতেই আসবে।’